আল্লাহ আমাদের সৃষ্টিকর্তা। আল্লাহই আমাদের রিজিকদাতা। যে রিজিক পাই, সেই রিজিকে বরকতদাতা তিনি। অনেক মানুষের অনেক কিছু আছে, আয়ের অনেক পথ আছে কিন্তু তবুও কেমন যেন নেই-নেই শব্দ। এর মানে হল তার রিজিকে বরকত নেই। রিজিকে বরকত থাকলে অল্পতে সব হয়। অভাব থাকে না। পক্ষান্তরে বরকত না থাকলে অভাব ঘোঁচে না। বেশীতেও কিছুই হয় না।
⚫ রিজিকে বরকত পাওয়ার উপায় :
📌 পরিপূর্ণ ঈমান রাখা, তাকওয়া অবলম্বন করা (আল্লাহকে ভয় করে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা) :
মহান আল্লাহ বলেন,
وَلَوْ أَنَّ أَهْلَ ٱلْقُرَىٰٓ ءَامَنُوا۟ وَٱتَّقَوْا۟ لَفَتَحْنَا عَلَيْهِم بَرَكَٰتٍ مِّنَ ٱلسَّمَآءِ وَٱلْأَرْضِ وَلَٰكِن كَذَّبُوا۟ فَأَخَذْنَٰهُم بِمَا كَانُوا۟ يَكْسِبُونَ.
“আর যদি জনপদের অধিবাসীবৃন্দ ঈমান আনতো ও তাকওয়া অবলম্বন করতো, তাহলে তাদের জন্য আমি আসমান ও জমিনের বরকতসমূহের দরজা খুলে দিতাম।” (সূরা আরাফ : ৯৬)
আল্লাহ আরো বলেন:
وَمَن يَتَّقِ ٱللَّهَ يَجْعَل لَّهُۥ مَخْرَجًا وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُۚ وَمَن يَتَوَكَّلْ عَلَى ٱللَّهِ فَهُوَ حَسْبُهُۥٓۚ إِنَّ ٱللَّهَ بَٰلِغُ أَمْرِهِۦۚ قَدْ جَعَلَ ٱللَّهُ لِكُلِّ شَىْءٍ قَدْرًا
“যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করবে, আল্লাহ তার জন্য উদ্ধারের পথ সহজ করে দেন এবং এমন জায়গা থেকে তাকে রিজিক দান করেন, যে জায়গা থেকে রিজিক আসার কথা সে কল্পনাও করেনি।” (সূরা ত্বলাক্ব ২-৩)
📌 তাওয়াক্কুল বা আল্লাহর উপর ভরসা করা :
“আর যে আল্লাহর উপর ভরসা রাখে, তিনিই তার জন্য যথেষ্ট হন।” (সূরা ত্বলাক্ব ৩)
হযরত উমর (রা.) বলেছেন, আমি রসূলুল্লাহ (স.)-কে বলতে শুনেছি:
لَوْ أَنَّكُمْ تَوَكَّلْتُمْ عَلَى اللَّهِ حَقَّ تَوَكُّلِهِ لَرَزَقَكُمْ كَمَا يَرْزُقُ الطَّيْرَ تَغْدُو خِمَاصًا وَتَرُوحُ بِطَانًا.
“তোমরা যদি যথার্থরূপে আল্লাহর উপর ভরসা রাখ, তাহলে ঠিক সেই রকম রিজিক পাবে, যে রকম পাখীরা রিজিক পেয়ে থাকে; সকালবেলায় ওরা খালি পেটে বের হয়ে যায় এবং সন্ধ্যাবেলায় ভরা পেটে বাসায় ফিরে আসে।” (তিরমিযী, আহমাদ)
📌 সর্ব অবস্থায় কৃতজ্ঞতা বা শুকরিয়া আদায় করা :
মহান আল্লাহ বলেন:
وَإِذْ تَأَذَّنَ رَبُّكُمْ لَئِن شَكَرْتُمْ لَأَزِيدَنَّكُمْۖ وَلَئِن كَفَرْتُمْ إِنَّ عَذَابِى لَشَدِيدٌ.
"যখন তোমাদের রব ঘোষণা করেছিলেন, তোমরা কৃতজ্ঞ হলে তোমাদেরকে অবশ্যই অধিক দান করব, আর অকৃতজ্ঞ হলে অবশ্যই আমার শাস্তি হবে কঠোর। (সূরা ইবরাহীম : ৭)
মহান আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয় আল্লাহ কৃতজ্ঞ বান্দাদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকেন।” (সূরা আলে ইমরান ১৪৪)
মহান আল্লাহ আমাদেরকে যেসব নেয়ামত দান করেছেন, তা গুনে শেষ করা যাবে না। এই সকল নেয়ামতের শুকর আদায় করা আমাদের জন্য ফরয। শুকর আদায়ের নিয়ম হল—
প্রথমত, অন্তরে স্বীকার করা যে, এই নেয়ামত আল্লাহর তরফ থেকে এসেছে।
দ্বিতীয়ত, মুখে তার শুকর আদায় করা।
তৃতীয়ত, কাজেও শুকর প্রকাশ করা। অর্থাৎ, সেই নেয়ামত তাঁরই সন্তুষ্টির পথে; গরীব-মিসকীনদের অভাব মোচনের পথে, আল্লাহর দ্বীনকে প্রতিষ্ঠা করার পথে খরচ করা।
📌 বেশি বেশি ইস্তিগফার ও ক্ষমা প্রার্থণা করা :
বেশি বেশি ইস্তিগফার (আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা) করলে তাতে রিজিকে বরকত আসে। মহান আল্লাহ হযরত নূহ (আলাইহিস সালাম)-এর কথা উল্লেখ করে বলেন:
فَقُلْتُ ٱسْتَغْفِرُوا۟ رَبَّكُمْ إِنَّهُۥ كَانَ غَفَّارًا يُرْسِلِ ٱلسَّمَآءَ عَلَيْكُم مِّدْرَارًا وَيُمْدِدْكُم بِأَمْوٰلٍ وَبَنِينَ وَيَجْعَل لَّكُمْ جَنّٰتٍ وَيَجْعَل لَّكُمْ أَنْهٰرًا
"আমি তাদেরকে বলেছি, নিজ রবের কাছে ইস্তিগফার (ক্ষমা প্রার্থনা) করো। নিশ্চয়ই তিনি মহাক্ষমাশীল। তিনি আকাশ থেকে তোমাদের জন্য প্রচুর বৃষ্টি বর্ষণ করবেন। তিনি তোমাদেরকে ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দ্বারা সমৃদ্ধ করবেন। আর তোমাদের জন্য বাগান তৈরী করে দেবেন এবং প্রবাহিত করে দেবেন নদী-নালা।" (সূরা নূহ : ১০-১৩)
منْ لَزِم الاسْتِغْفَار، جَعَلَ اللَّه لَهُ مِنْ كُلِّ ضِيقٍ مخْرجًا، ومنْ كُلِّ هَمٍّ فَرجًا، وَرَزَقَهُ مِنْ حيْثُ لاَ يَحْتَسِبُ.
যে ব্যক্তি সবসময় ইস্তিগফার করতে থাকে (গুনাহ মাফ চাইতে থাকে) আল্লাহ তাকে প্রতিটি সংকীর্ণতা / কষ্টকর অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ করে দেন, প্রতিটি দুশ্চিন্তা থেকে তাকে মুক্ত করেন এবং তিনি তাকে এমন সব উৎস থেকে রিযক দেন যা সে কল্পনাও করেনি। (আবূ দাঊদ)
📌 দান-সদাকাহ করা :
কৃপণতা না করে যেটুকুই অর্থ আছে, তা থেকে কিছু করে দান করা। কারণ, দান করলে সম্পদে বরকত হয় এবং কার্পণ্যে মাল ধ্বংস হয়। মহান আল্লাহ বলেন:
قُلْ إِنَّ رَبِّى يَبْسُطُ ٱلرِّزْقَ لِمَن يَشَآءُ مِنْ عِبَادِهِ ۦ وَيَقْدِرُ لَهُ ۥۚ وَمَآ أَنفَقْتُم مِّن شَىْءٍ فَهُوَ يُخْلِفُهُ ۥۖ وَهُوَ خَيْرُ ٱلرّٰزِقِينَ
"বলো, ‘আমার রব তাঁর বান্দাদের মধ্যে যার জন্য ইচ্ছা তার রিজিক বাড়িয়ে দেন অথবা সীমিত করেন। তোমরা যা (আল্লাহর পথে) খরচ কর, আল্লাহ তার স্থলে আরো প্রদান করে থাকেন। আর তিনিই শ্রেষ্ঠ রিজিকদাতা।" (সূরা সাবা : ৩৯)
রসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, "আল্লাহ বলেন, "হে আদম সন্তান! তুমি (অভাবীকে) দান কর আমি তোমাকে দান করব।" (মুসলিম)
মহানবী (স.) বলেন “বান্দা প্রত্যহ ভোরবেলায় উপনীত হলেই দুই ফিরিশতা (আসমান হতে) অবতরণ করে, তাদের একজন বলেন, হে আল্লাহ! তুমি দানশীলকে প্রতিদান দাও।' আর দ্বিতীয়জন বলেন, হে আল্লাহ! তুমি কৃপণকে ধ্বংস দাও।” (বুখারী, মুসলিম)
আল্লাহর রসূল (স.) এর যুগে দুই ভাই ছিল। একজন নবী (স.) এর নিকট উপস্থিত হয়ে তাঁর হাদীস ও ইলম শিক্ষা করত। অপরজন কোন হাতের কাজ করে অর্থ উপার্জন করত। একদা এই শিল্পী ভাই নবী (স.) এর নিকট হাযির হয়ে অভিযোগ করল যে, তার ঐ (তালেবে ইলম) ভাই তার শিল্পকাজে কোন প্রকার সহায়তা করে না। তা শুনে তিনি তাকে উত্তরে বললেন, “সম্ভবতঃ তুমি ওরই (ইলম শিক্ষার বরকতে) রিজিক পাচ্ছ। (তিরমিযী)
অসহায়দেরকে দান করার পাশাপাশি দূর্বল-অসহায়দের প্রতি সহানুভূতি দেখালেও রিজিকে বরকত হয়। নবীজি (স.) বলেন:
هَلْ تُنْصَرُوْنَ وَتُرْزَقُوْنَ إِلَّا بِضُعَفَائِكُمْ.
"তোমরা দুর্বলদের (দু‘আয়) ওয়াসীলায়ই সাহায্য প্রাপ্ত ও রিজিক প্রাপ্ত হচ্ছ।" (বুখারী)
📌অভাব পড়লে মাথা উঁচু রাখা এবং অভাবের কথা শুধু আল্লাহর কাছে জানানো; কোন মানুষের কাছে নয় :
মহানবী (স.) বলেন, “যার অভাব আসে, সে যদি তা মানুষের কাছে (পূরণের কথা) জানায়, তাহলে তার অভাব দূর হয় না। কিন্তু যার অভাব আসে, সে যদি তা আল্লাহর কাছে (পূরণের কথা) জানায়, তাহলে তিনি বিলম্বে অথবা অবিলম্বে তার অভাব দূর করে দেন।” (তিরমিযী)
📌 ফজরের নামাযের পর নিয়মিত দুয়াতে রিজিক ও বরকত প্রার্থনা করা:
"আল্লা-হুম্মা ইন্নী আসআলুকা ইলমান না-ফিআঁউ অ রিযক্বান ত্বাইয়িবাঁউ অ আমালাম মুতাক্বাব্বালা।" অর্থাৎ, হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট উপকারী জ্ঞান, হালাল জীবিকা এবং গ্রহণযোগ্য আমল প্রার্থনা করছি। (ইবনে মাজাহ)
📌 নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত করা:
কুরআন হল বরকতময় জিনিস। নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত করলে রিজিকে বরকত হয়।
📌 সকাল সকাল কাজ শুরু করা:
ফজরের পর সকালের মাঝে বরকত আছে।
নবী (স.) বলেন, “হে আল্লাহ! তুমি আমার উম্মতের প্রত্যূষে বরকত দাও।”
আর তিনি কোন সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করলে সকাল-সকাল প্রেরণ করতেন। সাহাবী সখর (রা.) একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনিও সকাল-সকাল ব্যবসায় (লোক) পাঠাতেন। ফলে তিনি ধনবান হয়েছিলেন এবং তাঁর মাল-ধন হয়েছিল প্রচুর। (আবু দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ)
📌 হালাল উপার্জন করা এবং হারাম থেকে দূরে থাকা:
হারাম মালের পরিমাণ যত বেশীই হোক না কেন, পরিণামে তা কম হতে বাধ্য। আপাতদৃষ্টিতে তা প্রচুর মনে হলেও বাস্তবে তার কোন মান ও বরকত থাকবে না। এ শাস্তি হবে আল্লাহর তরফ থেকে।
📌 খাবারে বরকত পেতে সুন্নাহ অনুযায়ী খাওয়া:
মহানবী (স.) বলেন, “খাবারের মধ্যভাগে বরকত নামে। অতএব তোমরা মাঝখান থেকে খেয়ো না।” (বুখারী)
📌 আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা:
হযরত আনাস ইবনে মালিক রাদি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসূল (স.)-কে বলতে শুনেছি:
مَنْ سَرَّهُ أَنْ يُبْسَطَ لَهُ رِزْقُهُ أَوْ يُنْسَأَ لَهُ فِي أَثَرِهِ فَلْيَصِلْ رَحِمَهُ.
“যে ব্যক্তি পছন্দ করে যে, তার রিজিক বৃদ্ধি হোক অথবা তাঁর মৃত্যুর পরে সুনাম থাকুক, তবে সে যেন আত্মীয়ের সঙ্গে সদাচরণ করে।” (বুখারী)
রসূলুল্লাহ (স.) বলেন, “যে ব্যক্তি চায় যে, তার রিজিক (জীবিকা) প্রশস্ত হোক এবং আয়ু বৃদ্ধি হোক, সে যেন আল্লাহকে ভয় করে এবং তার আত্মীয়তার বন্ধন বজায় রাখে।” (ইবনে হিব্বান)
📌 বিয়ে করা :
মহান আল্লাহ বলেন:
وَأَنكِحُوا۟ ٱلْأَيَٰمَىٰ مِنكُمْ وَٱلصّٰلِحِينَ مِنْ عِبَادِكُمْ وَإِمَآئِكُمْۚ إِن يَكُونُوا۟ فُقَرَآءَ يُغْنِهِمُ ٱللّهُ مِن فَضْلِهِ ۦۗ وَٱللّهُ وٰسِعٌ عَلِيمٌ
তোমাদের মধ্যে যারা অবিবাহিত (তারা পুরুষ হোক বা নারী) তাদের বিবাহ দিয়ে দাও এবং তোমাদের দাস-দাসীদের মধ্যে যারা বিবাহের উপযুক্ত, তাদেরও। তারা অভাবগ্রস্ত হলে আল্লাহ নিজ রহমতে তাদেরকে অভাবমুক্ত করে দিবেন। আল্লাহ অতি প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ। (সূরা নূর :৩২)
📌 হজ্জ-উমরাহ করা :
আল্লাহর রসূল (স.) বলেছেন— “তোমরা হজ্জকে উমরাহ ও উমরাহকে হজ্জের অনুগামী কর। (অর্থাৎ হজ্জ করলে উমরাহ ও উমরাহ করলে হজ্জ কর।) কারণ, হজ্জ ও উমরাহ উভয়েই দারিদ্র ও গুনাহসমূহকে সেইরূপ দূরীভূত করে যেরূপ (কামারের) হাপর লোহার ময়লাকে দূরীভূত করে ফেলে।” (নাসাঈ, তিরমিযী)
📌 হিজরত করা:
মহান আল্লাহ বলেন:
وَمَن يُهَاجِرْ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ يَجِدْ فِى ٱلْأَرْضِ مُرَٰغَمًا كَثِيرًا وَسَعَةً
"আর যে কেউ আল্লাহর পথে দেশ ত্যাগ করবে, সে পৃথিবীতে বহু আশ্রয়স্থল ও প্রাচুর্য লাভ করবে।" (সূরা নিসা :১০০)
Comments
Post a Comment