ইদানিং কালে বংশ কৌলিন্য নিয়ে এক শ্রেণীর মানুষ যেভাবে কোরাশ করছে তা বড়ই বেদনাকর বিষয়।
আমরা লক্ষ্য করেছি যে, তারা তাদের বংশ কৌলিন্য দেখিয়ে যেন মানুষকে বোঝাতে চায় যে, আমরা কুলিন বংশের মানুষ, সুতরাং হাজার অন্যায় করলেও আমাদের জন্য ক্ষমা। আর আল্লাহর বিচার কেবলমাত্র অকুলিনদের জন্য।
যদিও বিষয়টি আমাদের কাছে নতুন নয়! আমরা ইতিহাস পড়ে জানতে পারি যে, জাহিলী যুগেও মুশরিকদের মধ্যে এমন বংশ কৌলিন্যের উন্মাদনা বিরাজ করতো। এছাড়াও হিন্দুদের মধ্যে রয়েছে এই বংশ কৌলিন্যের বিরাট উন্মাদনা। আর সেই যুগসন্ধিক্ষণে ইসলাম এসে ঐ সমস্ত বংশ কৌলিন্যের গর্ব-অহংকার চিরতরে পৃথিবীর বুক থেকে বিদায় দেয়।
কিন্তু দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আজ ইসলামের সেই মতাদর্শের কিছু ভন্ড অনুসারী, আগেকার মুশরিকদের চর্বিত বিষ্ঠা নতুন করে চর্বন করতে শুরু করেছে। যেটা আমরা প্রায়ই শুনছি...
আর তাদের এই নিরেট জাহিলিয়াতের কারনে সমাজের মানুষ বিভ্রান্তের অতল তলে নিমজ্জিত হচ্ছে।
যদি আমরা কুরআন-হাদীসের দিকে একটু মনোযোগী হই, তাহলে বিষয়টা পরিস্কার বুঝতে পারবো। ইন শা- আল্লাহ !
আলোচনার শুরুতে পাঠকের অবগতির জন্য বিষয়টি পরিষ্কার করে বলে রাখছি যে—
🔴এক সময় এই ভারতবর্ষ মুসলিম শূন্য ছিল, ইসলাম পৃথিবীতে আসার পরে, মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলি থেকে মুসলিমরা ইসলাম প্রচারের জন্য ভারতে আসেন। এই ধারায় অনেক ব্যক্তিই প্রসিদ্ধ রয়েছেন। তাদের ভিতরে ফুরফুরার পীর দাদা হুজুর (রহ.) এঁর ১৫তম উর্ধ্বতন পুরুষ হজরত মাওলানা মুনসুর বাগদাদী (রহ.)ও ইসলাম প্রচারের জন্য ভারতে আসেন। এই মুনসুর বাগদাদী ছিলেন - প্রথম খলিফা হযরত আবুবকর সিদ্দীক (রাঃ) ১৬তম অর্ধস্তন বংশধর।
আর হজরত আবুবকর সিদ্দিক (রা.) ছিলেন কুরাইশ গোত্রের তাই ফুরফুরার পীর সাহেবকেও কুরাইশী বলা হয়। যদিও আমরা তার জীবনপঞ্জি পড়ে দেখেছি যে, ফুরফুরার হজরত কখনই নিজেকে প্রথম খলিফা হযরত আবুবকর সিদ্দিক (রা.) এঁর বংশধর এবং কোরাইশী হওয়া নিয়ে গর্ববোধ করেননি।
কিছু নথি রয়েছে যেখানে ফুরফুরার পীর দাদা হুজুর (রহ.) এঁর স্বাক্ষর রয়েছে। সেখানে তিনি লিখেছেন— 'আহকারুন্নাস মোহাম্মদ আবুবকর ওফেয়া আনহু. প্রেসিডেন্ট -জমিয়তে ওলামা বাংলা আসাম।'
(শরিয়তে ইসলাম- শাওয়াল, হিজরী১৩৫৫, পৌষ,১৩৪৩)
অথচ তাঁরই অর্ধস্তন কিছু অপরিনামদর্শী জাহিল আউলাদ যাদের ভিতরে ইলম্ দৈনতা প্রকট, তারা নিজেদের জ্ঞান দৈনতা ঢাকতে নিজেদেরকে কুরাইশ বংশী, সৈয়দ বংশী, হাশেমী বলে বুক চাপড়াচ্ছেন। (যদিও এ দাবীগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা, বরং ফুরফুরার পীর আবুবকর সিদ্দিক রঃ কেবল মাত্র কুরাইশী ছিলেন। আর সে নসবনামাও সকলের কাছে রয়েছে। এখানে নতুন করে সংযোজন ও বিয়োজন করার কোনো জায়গা নেই।)
অথচ আমরা দেখেছি মুজাদ্দেদ জামান দাদা হুজুর (রহ.) নিজে কখনোই এভাবে বংশ গৌরবের বড়াই করেন নি।
কিন্তু আফসোস তাঁরই বংশধর কিছু জাহিল একদিকে যেমন ইসলামকে কুলষিত করছে, সাথে সাথে এই সমস্ত মহান ব্যক্তিদের নীতি আদর্শগুলি জলাঞ্জলি দিয়ে সিলসিলাকে হাস্যসম্পদে পরিনত করেছে।
তাই আসুন দেখে নেওয়া যাক ইসলামে বংশ কৌলিন্যের কোনো মর্যাদা আছে কি না...
♦আল্লাহর নবী (স.) বলেছেন—
انا سيد ولد ادم ولا فخر
আমি আদম সন্তানদের মধ্যে সর্বদিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ, কিন্তু এতে আমার কোনো গর্ব-অহংকার নেই। (মিশকাত)
দেখুন যিনি সৃষ্টির সেরা আল্লাহর পরে যাঁর মর্যদা তিনি বলছেন এতে আমার কোনো গর্ব-অহংকার নেই। আজ যে বা যারা নিজেদের বংশ কৌলিন্য নিয়ে গর্ব-অহংকার করেছে, তারা কি আল্লাহর রসূলের চেয়েও অধিক মর্যাদা বান❓
তাদের নিকট আমাদের প্রশ্ন আপনি কি হজরত মুহাম্মাদ (স.) এঁর আদর্শ মেনে চলেন, নাকি শয়তানের আদর্শ মেনে চলেন?
যারা মুহাম্মাদ (স.) এঁর আদর্শ মেনে চলেন তাঁদের বংশ কৌলিন্য নিয়ে মাছের মতো তড়পাতে তো দেখা যায় নি। ফুরফুরা সিলসিলার প্রান পুরুষ যার নাম ভাঙিয়ে আপনারা ব্যাবসা করে খাচ্ছেন সেই মুজাদ্দেদ জামান দাদা হুজুর (রহ.) তো কখনোই এমনভাবে বংশ কৌলিন্য নিয়ে টু-শব্দটুকুও করেন নি।
এখন পাঠকের নিকট আমার জিজ্ঞাসা আজ ফুরফুরার আউলাদগন যে ভাবে বংশ গৌরব নিয়ে উন্মাদনা সৃষ্টি করেছে এদের কে আপনি কি মনে করছেন?
♦আরো একটা হাদিস আপনাদের খিদমতে পেশ করি—
আল্লাহর রসূল (স.) বলেন-
انسابكم هذه ليست بمسبة على احد كلهم بنو آدم طف الصاع بالصاع لم تملءوه ليس لأحد على احد فضل الا بدين وتقوى
“তোমাদের বংশ পরিচয় এমন নয় যে, তোমরা এর কারনে অন্যকে মন্দ বলবে। তোমরা সবাই এক আদমের সন্তান। পাল্লার সমান পাল্লা। কোনো একদিক পূর্ণ করে নিতে পার না। দ্বীন ও আল্লাহভীতি ব্যতীত তোমাদের কাহারো উপর কাহার মর্যাদা নেই।" (মুসনাদে আহমাদ, মিশকাত- হাদীস নং৪৬৯৩)
এমন ভাবে অসংখ্য হাদীস রয়েছে যাতে বংশ গৌরবের কঠিন পরিনতির কথা বর্ণিত হয়েছে।
♦এখন আমরা কিছু বিখ্যাত মুফাসসিরদের নিয়ে আলোচনা করবো, তাঁরা বংশ গৌরব বিষায়ক কি মন্তব্য করেছেন দেখব।
পবিত্র কুরআনের মহান আল্লাহ বলেন---
يا ايها الناس انا خلقنكم من ذكر وانثى وجعلنكم شعوباو قبائل لتعارفوا أن اكرمكم عند الله أتقاكم
"হে মানব! আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি একজন পুরুষ ও একজন নারী হতে, এবং পরে তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি যাতে তোমরা একে অপরে পরিচত হতে পার, আর তোমাদের মধ্যে ওই ব্যক্তি মহান আল্লাহ নিকট অধিক মর্যাদাবান যে অধিকার মুত্তাকী অর্থাৎ খোদাভীরু।" (সুরা হুজরত, আয়াত-১৩)
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বিখ্যাত মুফাসসির ইবনু কাসীর রহঃ তার বিখ্যাত তাফসীর গ্ৰন্থ--"তাফসীরে ইবনে কাসীর"-এর মধ্যে লিখেছেন—
"এই পবিত্র আয়াতের উদ্দেশ্য এই যে, হজরাত আদম আঃ কে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করা হওয়ায় সারা দুনিয়ার মানুষ একই মর্যাদার অধিকারী। এখন যিনি যা কিছু ফজিলত লাভ করছেন বা করবেন তা হবে দ্বীনি কাজকর্ম এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যের ভিত্তিতে।
এই আয়াতটিতে গীবত হতে বিরত রাখা এবং একে অপরের অপদস্থ, অপমানিত এবং তুচ্ছ ও ঘৃনা করা হতেও নিষেধ করা হয়েছে।"
এর পর আল্লামা ইবনে কাসীর রহ. নিজের বক্তব্যের সমর্থনে যে হাদিস উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে থেকে কয়েকটি হাদীস-
১) রসূল (স.) বলেছেন—আল্লাহ তোমাদের চেহারা এবং তোমাদের ধনসম্পদের দিকে দেখেন না, বরং তিনি দেখেন তোমাদের অন্তরের দিকে এবং আমলের দিকে।
২) হজরত খারাস আল্-আসবী রাঃ হতে বর্নিত যে, তিনি রসূল (স.)-কে বলতে শুনেছেন, মুসলমানরা সকলেই পরস্পর ভাই-ভাই, কারো উপর কারো কোনোই ফজিলত নেই, শুধু তাকওয়ার মাধ্যমে ফজিলত রয়েছে।
৩) এছাড়াও হজরত হুজাইফা রাঃ হতে বর্নিত আছে, রসূল (স.) বলেছেন--তোমরা সবাই আদমের সন্তান। আর আদম আঃ হলেন মাটি দ্বারা সৃষ্টি। সুতরাং মানব সম্প্রদায় যেন তাদের বাপ-দাদাদের উপর গৌরব প্রকাশ করা হতে বিরত থাকে। তা না হলে তারা আল্লাহ তায়ালার নিকট বালুর ঢিবি অথবা আবী পাখি হতেও হাল্কা হয়ে যাবে। (তাফসীরে ইবনে কাসীর, খন্ড-১৭, পৃঃ-৪১-৪৩)
প্রিয় পাঠক! তাহলে আমরা তাহলে স্পষ্ট হলাম যে, ইসলামে বংশ কৌলিন্যের গর্ব করার কোনো স্থান নেই, বরং এটা কঠিন হারাম। এবং এটা জাহিলি যুগের মুশরেকদের কাজ বলে রসূল (স.) একাধিক হাদীসের মধ্যে উল্লেখ করেছেন।
এখন আপনাদের কাছে আমার জিজ্ঞাসা বর্তমানে দাদা হুজুর (রহ.)এঁর যে সমস্ত বংশধররা নিজেদেরকে কোরাইশী, সৈয়েদ, হাশেমি প্রভৃতি মিথ্যা বংশের বহর দেখিয়ে আকাশ-পাতাল উলোট-পালট করে দিচ্ছে এদের পরিনতি কি❓
এরা কি নিজেদের অযোগ্যতা ঢাকতে মিথ্যা বংশ গৌরবের প্রচার চালিয়ে, মুলত ইসলামের ভাবমূর্তি নষ্ট করেনি? যে ইসলামে নেই সাদা-কালোর পার্থক্য, নেই ধনী-গরীবের পার্থক্য, নেই বংশ গৌরবের কোনো স্থান...
এরা নিজেদেরকে কোরাইশী বলে অন্যকে তুচ্ছ জ্ঞান করছে, আর বোঝাতে চাইছে কোরাইশরা হলো শ্রেষ্ঠ জাতি এবং আল্লাহর কাছেও শ্রেষ্ঠ আসনের অধিকারী।
অথচ ইসলামী দর্শন হলো— কোরাইশ, হাশেমি, সৈয়দ, সেখ,গাজি, বলে কিছুই নেই, আল্লাহর কাছে যেটা দেখার বিষয় তা হলো, আল্লাহভীরুতা ও অন্তরের আমল।
আর অন্যান্য ধর্ম হতে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব তো এখানেই!
যে ব্যক্তির মধ্যে এই গুনগুলি বিদ্যমান থাকবে, সে যে ঘরেই জন্মগ্ৰহন করুক না কেন যদি ইসলামের ছায়াতলে আসে, তবুও সে একজন সমমর্যাদা সম্পন্ন বলেই বিবেচিত হবে। আর এরা এই আদর্শকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিচ্ছে। (আফসোস!)
♦লক্ষ্য করুন---
আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগে প্রিয়নবী (স.) ভবিষ্যত বাণী করে গেছেন---
هلكة أمتى على يدى غلمة من قريش.
আমার উম্মতের ধ্বংস নিহত রয়েছে কুরাইশদের কিছু যুবকের হাতে। (বুখারী, মিশকাত ৫১৫৫)
আল্লাহই ভালো জানেন রসূল (স.) এঁর এই হাদীসটা কাদের দিকে ইজ্ঞিত করে...
♦হজরাত হুজাইফা রাঃ বলেন, " আমি রসূল (স.)-কে জিজ্ঞাসা করলাম ইয়া রসূলাল্লাহ স.! আমরা যে কল্যাণের মধ্যে অবস্থান করছি এর পরে কি অকাল্যান আসবে? রসূল (স.) বললেন, হ্যাঁ আসবে! তবে তা হবে ধোঁয়াশা যুক্ত। হুজাইফা রাঃ বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ! ধোঁয়াশা কি প্রকৃতির হবে? রসূল (স.) বললেন, ওই সম্প্রদায় আমার সুন্নাত বর্জন করে অন্য তরিকা গ্ৰহন করবে এবং আমার দেখানো পথ ছেড়ে অন্যের দেখানো পথে পরিচালিত হবে। তখন তুমি তাদের মধ্যে ভালো কাজও দেখতে পাবে এবং মন্দ কাজও দেখতে পাবে। তিনি রসূল (স.)কে পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন, সেই অকল্যানের পরে কি অকল্যাণ আসবে? রসূল (স.) বললেন, হ্যাঁ! জাহান্নামের দরজায় দাঁড়িয়ে কতিপয় আহ্বানকারী লোকদেরকে তাদের দিকে আহ্বান করবে। আর যারা তাদের ডাকে সাড়া দেবে তাদেরকে তারা জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত করে ছাড়বে। তিনি বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ! তাদের পরিচয় আমাদেরকে জানিয়ে দিন! রসূল (স.) বললেন, তারা আমাদের মতো মানুষ হবে এবং আমাদের মতোই কথা বলবে। (বুখারী, মুসলিম)
এখন পাঠকদের নিকট আমার জিজ্ঞাসা এই হাদীসগুলি কোন দিকে ইজ্ঞিত করছে তা আপনারা ভাবুন।
হে আল্লাহ! আমাদের সকলকে সঠিক বোঝার তৌফিক দান করুন এবং আমাদেরকে ভ্রান্ত মতপথ থেকে মুক্তি দিন; আমাদেরকে ক্ষমা করে দিয়ে আপনার দরবারে ইলাহিতে কবুল করুন। (আ-মীন)
Comments
Post a Comment